পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম আর নেই। ২১ ডিসেম্বর ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের কুইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে সোনালি আঁশের সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। তার ছোট ভাই জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের পরিচালক মাহবুবুল আলম জানান, মাকসুদুল আলম লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। শেষ দিকে লিভারের সঙ্গে তার ফুসফুসও ঠিকমতো কাজ করছিল না। ম্যানোয়ার ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের অধীনে কলেজ অব ন্যাচারাল সায়েন্সেসে জিনোমিকস, প্রোটিওমিকস ও বায়োইনফরমেটিকস বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করে আসছিলেন তিনি। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী হাওয়াই মেমোরিয়াল পার্ক সিমেট্রিতে মাকসুদুল আলমের লাশ দাফন করা হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
মাকসুদুল আলমের মৃত্যুতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। গত ৫ জানুয়ারি, ২০১৫ কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিএআরসি অডিটোরিয়ামে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এ মাহফিলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, কৃষি সচিব ড. এস এম নাজমুল ইসলামসহ মরহুমের আত্মীয়স্বজন এবং কৃষি মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন।
নিবিষ্ট বিজ্ঞানসাধক মাকসুদুল : বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় ২০১০ সালে তরুণ একদল বিজ্ঞানীকে নিয়ে তোষা পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করে আলোচনায় আসেন মাকসুদুল আলম। ওই বছরের ১৬ জুন জাতীয় সংসদে দেশবাসীকে সেই সুখবর জানান প্রধানমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও খবরটি গুরুত্ব পায়।
প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জানান, মাকসুদুল ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা নামের এক ছত্রাকের জিন-নকশা উন্মোচন করেছেন, যা পাটসহ প্রায় ৫০০ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়।
গত বছরের ১৮ আগস্ট মাকসুদুলকে পাশে নিয়েই বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আরেকটি বড় সাফল্যের খবর জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার আসে দেশি পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের খবর।
জিনোম হলো প্রাণী বা উদ্ভিদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। এই নকশার ওপরই নির্ভর করবে ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য। গবেষণাগারে এই জিনবিন্যাস অদলবদল করে উন্নত জাতের পাট উদ্ভাবন সম্ভব।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী এর নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পাটের গুণগত মান ও উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব। আর নতুন জাত উদ্ভাবন করা হলে পাট পচাতে কম পানি লাগবে, আঁশ দিয়ে জৈব-জাল্বানি ও ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে।
এর আগে ২০০৮ সালে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পেঁপে এবং মালয়েশিয়া সরকারের হয়ে রাবার গাছের জীবনরহস্য উন্মোচনেও নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের এই গবেষক। পেঁপে নিয়ে তার কাজের বিষয়ে বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়। ওই প্রতিবেদনে মাকসুদুলকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় ‘বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবক’ হিসেবে।
বর্ণাঢ্য জীবন : ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ফরিদপুরে জন্ম নেয়া মাকসুদুল আলমের বাবা দলিলউদ্দন আহমেদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (বর্তমান বিজিবি) একজন কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন তিনি। স্বামীকে হারিয়ে চার ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে কঠিন সংগ্রামে পড়তে হয় মাকসুদুলের মা লিরিয়ান আহমেদকে। তবে তার চেষ্টায় ছেলেমেয়েরা যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে মাকসুদুল রাশিয়ায় চলে যান। ১৯৭৯ সালে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি অণুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। ১৯৮২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অণুপ্রাণবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন মাকসুদুল। এর পাঁচ বছর পর জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব বায়োকেমিস্ট্রি থেকে প্রাণরসায়নেও তিনি পিএইচডি করেন।